• বাংলাদেশ

    অপরাধ, দ্রব্যমূল্য ও তথ্যবিকৃতির জোড়া সংকট: দায় এড়ানোর সুযোগ নেই

      প্রতিনিধি ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ , ২:৫৫:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ

    আওরঙ্গজেব কামাল: রাষ্ট্র ও সমাজের আজকের অবস্থার বিচার করতে গেলে একাধিক প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়—এই সংকট কি আকস্মিক, নাকি দীর্ঘদিনের অবহেলা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ছাড়ের ফল? জনগণ যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে দম আটকে যাচ্ছে, তখন অপরাধ ও চাঁদাবাজির তাণ্ডবে তাদের নিরাপত্তাবোধও ভেঙে পড়ছে। এই দুই চাপ একত্রে সাধারণ মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার অতলে ঠেলে দিয়েছে। জুলাই এর গণঅভ্যুত্থানের পরে ছাত্র-জনতার রক্তে বহু আশা নিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশের আশা জাগিয়েছিল। কিন্তু ছাত্র জনতার সেই আশা এখন নিরাশাই পরিণত হচ্ছে। একদিকে রাজনীতির অস্থিরতা অপরদিকে লাগামহীন দ্রব্য মূল্যের দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি যেন জনমনে না বিশ্বাস হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ জনেরা বলছেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক ব্যর্থতা। যে রাষ্ট্র বাজার মনিটর করতে ব্যর্থ, সে রাষ্ট্র তার নাগরিকের পাতে ভাত রাখতে পারে না। পণ্যের দাম যখন জনগণের আয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়,মধ্যবিত্ত যখন নিম্নবিত্তের সারিতে দাঁড়ায়,তখন দায় শুধু বাজারের নয়—নীতি ও তদারকিরও । এখানে ব্যর্থতার বিচার করলে প্রশাসন এবং নীতিনির্ধারক সংস্থাগুলো দায়মুক্ত নয়। এছাড়া অপরাধ দমনে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রাধান্য চাঁদাবাজি, খুন, দখলবাজি ও হয়রানি—এসব অপরাধ আজ বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সংগঠিত বাস্তবতা।যেখানে অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে নিরাপদ থাকে,যেখানে ভুক্তভোগী মুখ খুলতে ভয় পায়—সেখানে বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতা প্রমাণিত। আর এই অপরাধমূলক কর্মকান্ডের হাত থেকে সাংবাদিক রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ রক্ষা পাচ্ছে না। কেন এমন হচ্ছে আমার প্রশ্ন হলো আইনের কাছে সবাই কি সমান? নাকি রাজনৈতিক সম্পর্কই এখন বিচার নির্ধারণের ছক? সকলে কি সমান বিচার পাবে না। এখনো কেন বৈষম্য মুক্ত হলো না। এখনো থানায় টাকা লাগছে। পুলিশ মামলা তদন্তে টাকা গ্রহণ করছে। মামলা করে আসামীর খেতে বাদিরা বিপাকে বেশি। এমন অভিযোগের অন্ত নেই। ছাত্র-জনতার রক্তের ওপার দাঁড়িয়ে এই গণতন্ত্র নতুন বাংলাদেশ আমরা কখনো চাইনি। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক নীরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমি জানিনা এটা প্রশাসনের অক্ষমতা নাকি ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা? মামলা হয় না, তদন্ত ধীর, বিচার বিলম্বিত—এগুলো কেবল ব্যর্থতা নয়, এক প্রকার উদাসীনতার প্রতিচ্ছবি। অপরাধীরা যখন আইনের ফাঁক গলে পালিয়ে যায়, তখন তা কেবল ব্যক্তি-অভিযোগ নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর সরাসরি রায়। এসব পরিস্থিতি থেকে সাধারণ জনগণ মুক্তি চাই। এছাড়া বর্তমানেসোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা প্রচারণার লাগামহীনতা পুরোনো ছবি জুড়ে নতুন আতঙ্ক, উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার, চরিত্রহনন—এসব যেভাবে ছড়াচ্ছে, তা কেবল জনমত নয়, সামাজিক আস্থা ও আইনশৃঙ্খলাকেও ধ্বংস করছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত অনলাইনে ব্যাপক প্রগন্ড চালাচ্ছে। এটা রাষ্ট্রের চরম ক্ষতি হচ্ছে। দেশি-বিদেশি facebook ফেক আইডির জন্য সাধারণ জনগণ থেকে সরকার পর্যন্ত নাস্তানাবুদ হচ্ছে। সব বিষয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ করেও ফল পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা।
    এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্ন তোলে—তথ্য অধিকার কি কেবল বিভ্রান্তির কাছে আত্মসমর্পণ করবে?
    নৈতিক অবক্ষয় ও রাষ্ট্র-সমাজের দায় দ্রব্যমূল্যের চাপ, বেকারত্ব ও নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে চাপে ফেলছে এটা সঠিক নয় কি? যখন টিকে থাকার লড়াই বেআইনি পথে ঠেলে দেয়, তখন দায় শুধু ব্যক্তির নয়—পরিবেশ তৈরির জন্য রাষ্ট্রও সমানভাবে দায়ী থাকে। এসব বিষয়ে কোন প্রকার ভাবে রাষ্ট্র দায় আড়াতে পারে না। আর আমি মনে করি রাষ্ট্র যদি দায় স্বীকার করে তাহলে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা জানি রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধ দমন ছাড়া আইনের শাসন ফিরবে না। তবুও চেষ্টা করতে দোষ কি। বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর অভিযান ও তদারকি জরুরি। এ ব্যাপারে সরকার কি পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজিটাল অপপ্রচার দমনে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বাড়াতে হবে। বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ত্বরিত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে হয়তো জুলাই গণঅভ্যুত্থান শবর ও সার্থক হবে। যদি দেশে বিচারের আর বিলম্বের সুযোগ না থাকে তাহলে হয়তো অফরাট প্রবণতা কমে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতি আর ‘স্বাভাবিক সংকট’ নয়, বরং এক যৌথ অব্যবস্থাপনা ও শাসনদুর্বলতার ফলাফল। এখন যদি রাষ্ট্র নিজেকে সংশোধনের রায় না দেয়, তবে জনগণ একদিন রায় ঘোষণা করবেই—সে রায় হোক ভোটে, প্রতিবাদে বা ইতিহাসে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় অংশই তরুণ। কিন্তু চাকরি ও আয়ের সুযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা কার্যকরভাবে উৎপাদনশীল শক্তিতে পরিণত হতে পারছে না। যখন শিক্ষিত তরুণ দীর্ঘদিন বেকার থেকে যায়, তখন হতাশা থেকে তারা সহজে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়, সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বা সাইবার অপরাধে অংশ নেয়। কথায় আছে “ক্ষুধার নখে ভয়” অর্থাৎ যখন একজন মানুষ খুব ক্ষুধার্ত বা জীবনধারায় বাধাগ্রস্ত হয়, তখন তার কাছে আইন ও নৈতিকতার মূল্য কম মনে হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে উঠে আসে বর্তমানে দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ ৬০ হাজার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়ম অনুসারে, বেকার মূলত তারাই, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং এক মাস ধরে কাজ খুঁজেছেন, কিন্তু মজুরির বিনিময়ে কোনো কাজ পাননি। বিবিএস এই নিয়ম অনুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে। এছাড়াও বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী পুরুষ ও নারী উভয় ক্ষেত্রেই বেকারত্ব বাড়ছে তবে পুরুষদের হার নারীদের তুলনায় কিছুটা বেশি। বাংলাদেশে বিশালসংখ্যক নিষ্ক্রিয় তরুণ-তরুণী আছেন। তাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। এই শ্রেণির বেকারদের মূলত “ছদ্মবেকার” বলা হয় যাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি পৌঁছেছে, যারা কাজ করছে না, পড়াশোনা করছে না এবং প্রশিক্ষণও নিতেছে না। আর বেকারত্বের অভিশাপে এই বড় জনগোষ্ঠীর মানুষরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও অনলাইন প্রতারণার মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেকারত্ব একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সংঘটিত মাদকসংক্রান্ত অপরাধের ঘটনায় আটককৃতদের ৭২% ছিল ২০-৩৫ বছর বয়সী। অর্থাৎ কর্মসংস্থানের অভাব তরুণ-তরুণীদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি। আমার মতে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে যুবসমাজ অপরাধের অন্ধকার পথ থেকে বেরিয়ে এসে জাতির উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারবে। এজন্য সরকারকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।
    লেখক ও গবেষক:
    আওরঙ্গজেব কামাল
    সভাপতি
    ঢাকা প্রেসক্লাব।



    আরও খবর

    Sponsered content